Connect with us

সাহিত্য

রহিম সাহেবের চাঁদ 

জালাল উদ্দিন লস্কর

Published

on

ছবি | রহিম সাহেবের চাঁদ 

রহিম সাহেব ঢাকায় থাকেন।একটি সরকারী অফিসে অফিস সুপার পদে চাকুরী করেন।ঢাকায় তিনি একাই থাকেন।রহিম সাহেবের পরিবার পরিজন গ্রামের বাড়ীতে থাকেন।বাড়ীতে বৃদ্ধ বাবা মা আছেন।রহিম সাহেবের স্ত্রী একটি হাইস্কুলের শিক্ষক।পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেছেন।বাচ্চাকাচ্চা হয় নি এখনো।কতোবার স্ত্রীকে  চাকুরীটা ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে আসতে বলছেন।স্ত্রী রাজী হন না।স্বাধীনচেতা স্বভাবের মেয় রহিম সাহেবের স্ত্রী শম্পা।কিছুটা একরোখাও।ভেতরটা সরল।সাদাসিদা মনের মানুষ।শশুর শাশুরীর প্রতি যথেষ্ট কেয়ারিং।রহিম সাহেবের বৃদ্ধ বাবা মা এমন বউমা পেয়ে খুবই খুশী।তারাও শম্পাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালবাসেন।আদর করেন।রহিম সাহেবের বাবা সাদেক উদ্দিন সমবায় অফিসে চাকুরী করতেন।অবসরে গেছেন অনেক আগে।মাসে মাসে পেনশন পান।পেনশনের টাকা উঠাতে বাড়ী থেকে বিশ কিলোমিটার দূরের সোনালী ব্যাংকে যেতে হয়।প্রতিমাসে না গিয়ে ৩/৪ মাস পরপর গিয়ে একবার টাকা তুলে আনেন।ভাল টাকাই পান পেনশন বাবদ।ব্যাংক থেকে টাকা তুলে এনে বউমা শম্পার হাতে সব টাকা তুলে দেন।প্রথম প্রথম প্রথম শম্পা টাকা নিতে রাজী হয় নি।শশুরের পীড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত টাকাটা নিতে রাজী হয়।শম্পার নিজের ইনকাম আছে।হাইস্কুলের  শিক্ষক।স্কুলটি এমপিওভুক্ত না হলেও প্রচুর ছাত্রছাত্রী তার স্কুলে।স্কুলের রেজাল্টও বরাবরই ভালো।অভিভাবকেরা সন্তুষ্ট শিক্ষকদের প্রতি।সম্মানজনক বেতন পান এ স্কুলের শিক্ষকেরা।রহিম সাহেব যতোবারই শম্পাকে চাকুরী ছেড়ে দিতে বলেন শম্পা ততোবারই জেদ ধরে।সরকারী একটা চাকুরী পেলে এ চাকুরীটা ছেড়ে দেবে।এখনো শম্পার সরকারী চাকুরীতে আবেদনের বয়স শেষ হয়ে যায় নি।অনেকখানেই দরখাস্ত করেছে।ইন্টারভিউও দিয়েছে।প্রতিবারই ভাইবাতে ডাক পায়।তারপর আর খবর থাকে না।শম্পা আত্মপ্রত্যয়ী।তার ধারণা সরকারী চাকুরী সে পাবেই।

এদিকে রহিম সাহেবের বাবা মা অনেক আশা করে আছেন কবে শম্পার কোল আলো করে একটা নাতি নাত্নী আসবে।বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর।সাদেক উদ্দিনই পছন্দ করে পাশের গ্রাম দৌলতপুরের রউফ মাতব্বরের মেয়ে শম্পাকে পুত্রবধু করে এনেছিলেন।এলাকায় প্রথম যৌতুক বিহীন বিয়ে।সাদেক উদ্দিন রউফ মাতব্বরকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি এ বিয়েতে এক টাকাও যৌতুক নেবেন না।রউফ মাতব্বর তার একমাত্র মেয়ে শম্পার বিয়ে ধুমধাম করেই দেন।যৌতুক ছাড়াও ছেলে মেয়ের বিয়ে হতে পারে এরাকাবাসীর ধারণাতেই ছিল না।যৌতুকবিহীন এ বিয়ের খবরট স্থানীয় এবং জাতীয় পত্রপত্রিকাতে ফলাও করে প্রচারিত হয়।বিয়ের দিন হঠাৎ রউফ মাতব্বরের বাড়ীর সামনে একটি দামী সরকারী গাড়ী এসে থামে।সাথে আরো কয়েকটি গাড়ী।স্বয়ং জেলা প্রশাসক মহোদয় নিজে থেকে এসেছেন বরকনেকে আশীর্বাদ করতে।সাথে আরো অনেক সরকারী কর্মকর্তা।রউফ মাতব্বর অবাক হয়ে যান।নিজেকে ধন্য মনে করেন। এ বিয়েটিকে একটি মডেল বিয়ে হিসাবে ধরে নিয়ে জেলা নারীমুক্তি সংস্থা সমগ্র প্রতাপগঞ্জ জেলায় যৌতুকবিরোধী আন্দোলন জোরদার করে।সুফলও পাওয়া যায়।আস্তে আস্তে আরও অনেক যৌতুক বিহীন বিয়ে হতে থাকে এলাকায়।জেলাজুড়ে শম্পা হয়ে উঠে যৌতুকবিরোধী আইকন।কিন্তু সাদেক উদ্দিন সাহেবের মন থেকে কুটকুটানী যায় না।কবে শম্পা মা হবে!সাদেক উদ্দিন একবার অনেকটা জোর করেই শম্পাকে নিয়ে যান জেলার এক নামকরা গাইনোকোলজিস্টের কাছে।পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কোনো সমস্যা পাওয়া যায় না।শম্পার স্বামী রহিম সাহেবকে একবার দেখা দরকার।তার কোনো সমস্যা রয়েছে কি না সেটা জানা দরকার জানিয়ে দেন গাইনোকোলজিস্ট ডাঃ সোনিয়া। সাদেক উদ্দিন চিন্তায় পড়ে যান।পুরুষ মানুষের আবার কি সমস্যা থাকতে পারে।তার ছেলে রহিম সুঠামদেহী যুবক।নিরোগ ও স্বাস্থ্যবান।একসময় নিয়মিত শরীরচর্চ্চা করতো।নামাযীও।ভাবনায় পরে গেলেন সাদেক উদ্দিন।

বাড়ী ফিরে রহিমকে ফোন কররেন সাদেক উদ্দিন।সামনের মাসে বাড়ী আসার সময় যেন ২/৩ দিনের ছুটি নিয়ে আসে বলে দিলেন।সরকারী চাকুরী।চাইলেই কি আর যখন তখন ছুটি পাওয়া যায়!রহিম সাহেবের কাছে পিতৃআজ্ঞার মূল্য অনেক।তিনিও পিতাকে আস্বস্ত করলেন যেভাবেই হউক সামনের মাসে বাপের কথামত ছুটি নিয়েই বাড়ী আসবেন।পরের মাসে বাড়ী আসলেন রহিম সাহেব।বাড়তি ছুটি নিয়েই এলেন।সাদেক উদ্দিন গাইনোকোলজিস্ট ডাঃ সোনিয়ার কাছে ফোন করে জেনে নিলেন কার কাছে রহিমকে নিয়ে গেলে ভালো হয়।ডাক্তার সোনিয়া ডাঃ আব্দুল গফুরের নাম ঠিকানা জানালেন।পরদিন সকালেই সাদেক উদ্দিন রহিমকে নিয়ে বাড়ী থেকে জেলা সদরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।রহিম একবারও জানতে চান নি কেন কোথায় যাচ্ছেন তারা।জেলা সদরে পৌঁছে ডাঃ আব্দুল জব্বারের চেম্বারে গিয়ে রহিমের নাম তালিকাভুক্ত করালেন সাদেক উদ্দিন।এতোক্ষণে রহিম বুঝতে  পারে কেন তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।আসলে এ বিষয়টি নিয়ে রহিম সাহেব কখনোই সেভাবে ভাবেন নি।নইলে ঢাকায় কতো নামকরা প্রফেসররা আছেন।আধুনিক সব বিশ্বমানের পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে ঢাকাতে।সেখানেই তো করাতে পারতেন সবকিছু।

কিছুটা লজ্জায় কিছুটা সংকোচে মাথা নত করে পিতা সাদেক  উদ্দিনের সামনে বসে রইলেন রহিম।রহিমের সিরিয়াল অনেক পিছনে।আরো ঘন্টাখানেক পরে তার ডাক পড়তে পারে।এ সুযোগে কাছের একটা সুপার মার্কেটে ঘুরে আসলে কেমন হয়।বাড়ী আসার পথে বাবা মা এবং শম্পার জন্য প্রতিমাসেই প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কাপড়চোপড়সহ নানা উপহার নিয়ে আসেন রহিম সাহেব। এবারও এনেছেন।তারপরেও যদি পছন্দের কিছু পাওয়া যায় শম্পার জন্য! ন্যান্সী শাড়ী হাউসে একটা সবুজ রঙের শাড়ী পছন্দ হয়ে গেলো রহিমের।সবুজ রঙ শম্পার খুব পছন্দের।প্রিয়তমার পছন্দের রঙের শাড়ীটি রহিম সাহেব কিনে নিয়ে বিল মিটিয়ে আবার ডাক্তারের চেম্বারে ফিরে এলেন।হাতের প্যাকেটা দেখে সাদেক উদ্দিন আগ্রহ ভরে জানতে চাইলেন কি এটা।রহিম সাহেব পিতার সামনে সংকুচিত ভঙ্গিতে বসে আছেন।কোনোকিছু না বলে প্যাকেটটা পিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে লাজুকভঙ্গিতে একটু হাসলেন।ঠিক এ সময় ডাক্তারের চেম্বারে ডাক পড়লো রহিম সাহেবের।তিনি চেম্বারে ঢুকে গেলেন।সাদেক উদ্দিন প্যাকেটের শাড়ীটা দেখে অনেকবেশী খুশী হলেন।তিনিও জানেন শম্পা সবুজ রঙ খুব পছন্দ করে।বুঝতে পারলেন শম্পার জন্যই এটি কিনেছে রহিম।রহিমের রুচি দেখে মুগ্ধ হলেন সাদেক উদ্দিন।মনেমনে অতীত জীবনে ফিরে গেলেন তিনি।যৌবনে এমন করেই স্ত্রী সখিনাকে ভালোবাসতেন সাদেক উদ্দিন।এখনও বাসেন।এখনও একসাথে খেতে বসেন।দুএক লোকমা মুখে তুলে দেন সখিনার।বৃদ্ধ সাদেক উদ্দিনের সখিনার প্রতি এমন ভালোবাসা শম্পাও উপভোগ করে।রহিমও তাকে পাগলের মতোই ভালোবাসে।ঢাকায় থাকলেও প্রতিদিন অনেকসময় নিয়ে ফোনে কথা বলেন।ভিডিও কল দেন।শম্পাকে ছাড়া তার একদমই ভালো লাগে না।কিন্তু চাকুরী করতে হলে এ কষ্ট মানতেই হবে।কিছুই করার নাই।ইচ্ছা করলেই এখন জেলা শহরে বদলী হয়ে আসা সম্ভব নয়।ডাক্তার আব্দুল জব্বার চিকিৎসক হিসাবে যেমন নামকরা তেমনি মানুষ হিসাবেও চমৎকার।অনেক সময় নিয়ে রহিম সাহেবের কেসহিস্ট্রি শুনেন।নানান প্রশ্ন করেন।কৌশলে জেনে নেন রহিম সাহেব স্ত্রীকে ছাড়া ঢাকায় একাই থাকেন।মাঝেমাঝে বাড়ী আসেন।দুএকদিনের বেশী থাকা হয় না।ডাক্তারের কিছু প্রশ্নে রহিম সাহেব সংকোচ বোধ করেন।লজ্জায় কুঁকড়ে যান।অকপটে স্বীকার করেন বাজে জায়গায় যাওয়ার অভ্যাস তার নেই।সাথের অনেক বন্ধুবান্ধব যদিও বা যায়।নিয়মিত নামায পড়েন।কিন্তু একটা ‘বিশেষ কাজ’ না করলে রাতে কিছুতেই ঘুমাতে পারেন না।ছাড়ার চেষ্টা করেছেন অনেক।পারেন না। ডাক্তার যা বুঝার বুঝে গেলেন।’সিমেন’ টেস্ট লিখে দিলেন।একানেই টেস্টের ব্যবস্থা আছে।দ্রুতই টেস্টের রিপোর্ট দেওয়া হয় এখানে।রিপোর্ট দেখে তারপর প্রেসক্রিপশন দিবেন।এ আরেক ঝক্কির টেস্ট!

অনেক কসরত করে বীর্য বের করতে হয়।মাস্টারবেশনের মতো ‘ইনজয়েবল’ নয় ঠিক।বিবাহিত মানুষ  হয়েও দূরবিদেশে থাকে বলে রহিম সাহেব নিয়মিতই এ কাজটা করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো একধরণের তৃপ্তি লাভ করে থাকেন।শম্পা সেটা জানে না।কখনো শম্পাকে বলা হয় নি।বলার মতো প্রসঙ্গ আসে নি।ঠিক সেই সময়টাতে রহিম সাহেব কার মুখচ্ছবি কল্পনা করেন?শম্পার? না পথ চলতি দেখা সুনয়না সুদর্শনা ললনাদের মধ্যে মনে গেঁথে থাকা কেউ কেউ তার ভিজুয়ালাইজেশনের(Visualisation) লক্ষ্যবস্তু হয় তা হলফ করে বলা যাবে না।

কাজ সেরে পিতা সাদিক উদ্দিনের কাছে এসে বসে রহিম।তাকে কিছুটা ক্লান্ত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।সাদেক উদ্দিন শুধু একবার জানতে চান এখানে আর কতোক্ষণ লাগতে পারে।ঘন্টাখানেক।রহিম সাহেবের নিস্পৃহ জবাব।কথা বাড়ান না সাদেক উদ্দিন।ভাবেন রিপোর্টটা আসলে তিনিও তখন ডাক্তারের সাথে দেখা করবেন।এক ঘন্টা লাগে নি।তার আগেই রহিমের ডাক পরে  এটেন্ডেন্স কাউন্টারে।সেখান থেকে রিপোর্ট নিয়ে এসে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতে যাবেন।ডাক্তার ভেতরে রোগী দেখছেন।দশ পনের মিনিট পরে রহিম সাহেব রিপোর্ট নিয়ে ভেতরে গেলেন।সাথেসাথে সাদেক উদ্দিন সাহেবও। রহিম সাহেব লজ্জায় আড়ষ্ট হলেন।মুখে কিছুই বলতে পারলেন না।রিপোর্ট দেখে ডাক্তারের মুখে স্মিত হাসি ফুঁটলো।

তিনি বুঝতে পারলেন সমস্যা তেমন গুরুতর নয়।সিমেনের কোয়ালিটি অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে রহিম সাহেবের।অতিমাত্রায় মাস্টারবেট করার কারনে।যাক এটা কাটিয়ে উঠা যাবে।বাজারে এ সমস্যার ভাল ঔষধ আছে।গছগছ করে প্রেসক্রিপশনের প্যাডে কয়েকটা ঔষধ আর খাওয়ার নিয়ম লিখে দিলেন।আরো বেশী করে বাড়ী আসার পরামর্শও দিলেন সাদেক উদ্দিনের সামনেই।একপর্যায়ে ডাক্তার সাহেব বিনয়ের সাথে সাদেক উদ্দিনকে বাইরে যেতে বললেন।সাদেক উদ্দিন বাইরে গেলে ডাক্তার সাহেব রহিম সাহেবকে বললেন,সে কাজটা(মাস্টারবেট) বাদ দিতে হবে।অনেক দিনের অভ্যাস।ছাড়তে কষ্ট হবে।এই কষ্টটা মেনে নিতেই হবে।নইলে ভবিষ্যতে সমস্যা জটিলতর হতে পারে।যে ঔষধগুলো দেওয়া হয়েছে সঠিক ব্যবহারে ৩/৪ মাসের মধ্যেই ফলাফল নিশ্চিত।

বাড়ী ফিরে আসলেন পিতাপুত্র।আর দুইদিন পরেই ঢাকায় ফিরতে হবে রহিম সাহেবকে।প্রিয় রঙের শাড়ী উপহার পেয়ে শম্পাও বেজায় খুশী।

ডাক্তার রহিমকে ঘনঘন বাড়ী আসতে বলেছে শুনে শম্পা মিটমিটিয়ে হাসে।মাসে একবার এসেই যে ‘নমুনার ভালবাসা’ দেখাও তুমি! ঘনঘন আসলে তোমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে তো!!রহিম বিব্রত হয়।তবে প্রতিবাদ করে না।

সে রাতে রহিমের কাছে এক অন্যরকম ভালোবাসাই পায় শম্পা।তারও ভালো লাগে।পরের দিনও একই অবস্থা।শম্পার ঘুম ভাঙ্গে যেন!রহিমের প্রতি শম্পার টানও কেমন জানি বেড়ে যায়।ঢাকায় ফিরে যাওয়ার দিন বারবার শম্পা রহিম সাহেবকে অনুনয় করে বলে যেন যেমন করেই হউক পরের সপ্তাহে অন্তত একদিনের জন্যে হলেও বাড়ী আসেন।শম্পার মনের মধ্যে গুনগুন করে উঠে সিনেমার চপল গানঃ ’যাবার আগে দোহাই লাগে একবার ফিরে চাও আবার তুমি আসবে ফিরে আমায় কথা দাও।’ঢাকায় ফিরে রহিম সাহেবও ছটফট করতে থাকে।শম্পার জন্য তার মন কেঁদে উঠে। পাঁচ বছরেও শম্পার কাছ থেকে এতোটা ভালবাসা রহিম সাহেব পান নি যা গত দুইদিনে পেয়েছেন।

পরের বৃহস্পতিবারে অফিস থেকে বেরিয়ে মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে টিকিট কিনে এনা পরিবহনের বাসে উঠে বসেন।সন্ধ্যার পরপরই বাড়ী পৌঁছে যান রহিম সাহেব।শম্পাকে ফোন করে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন।রহিম সাহেবকে দেখে শম্পাও যারপর নাই আনন্দিত। শুক্রবার  বাড়ীতে থাকবে।শনিবার বিকালে ঢাকায় রওনা দিলেও চলবে।সাদেক উদ্দিনও স্ত্রীর প্রতি রহিমের এটেনশন দেখে মনে মনে খুশীই হলেন।ডাক্তারের চিকিৎসা তাহলে কাজ দিতে শুরু করেছে।সেদিনও একে অপরকে পাগলের মতো ভালোবাসতে লাগলেন।ভালোবাসার এক অন্য দিগন্তে হারিয়ে গেলেন।

শম্পার মনে গুঞ্জরিত হতে লাগলোঃ ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলো ভাঙ্গলো ঝড়ে…এসেছিলে আমার ঘরে।’এভাবেই দিন যেতে লাগলো।রহিম সাহেব ডাক্তারের পরামর্শ আর শম্পার ‘মাথার কিড়াকে’ শিরোধার্য করে নিয়মিতই সপ্তায় সপ্তায় বাড়ী আসা শুরু করলেন।ঠিক চারমাস পরে শম্পা ফোনে রহিম সাহেবকে সুখবরটা দিলেন!

এ মাসের নির্ধারিত তারিখে তার পিরিয়ড শুরু হয় নি।রহিম সাহেব খুশী হলেন।তারপরও আরো কয়েকটা দিন দেখতে বললেন শম্পাকে।পিরিয়ডের অনিয়মের কারনেও অনেক সময় মেয়েদের এমন হয়ে থাকে।শম্পার কাছেই শোনা এসব।শম্পার কাছ থেকেই তার এ জ্ঞান অর্জন।

না এ মাসে আর পিরিয়ড হয় নি শম্পার।পরের মাসও এভাবে গেলো।কনসিভ করার বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেলো।শম্পা শিক্ষিত মেয়ে।মেয়েদের  এ সময়টার  নিয়মকানুন সবই তার জানা।সেভাবেই সবকিছু মেনে চলতে শুরু করলো।শশুর সাদেক উদ্দিন ও শাশুরী সখিনা বেগমের আনন্দ আর ধরে না।তারা নিয়মিত স্থাণীয় কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিবার কল্যান সহকারীর (এফডব্লিওএ)সাথে যোগাযোগ রাখতে শুরু করলেন।নিয়মিত চেক আপ (এএনসি) চলতে লাগলো শম্পার।কোনোরকমের জটিলতা দেখা গেলো না।সবাই আল্লাহর শোকর গোজারী করতে লাগলেন।

রমযানের ঈদের ছুটিতে রহিম সাহেব ঢাকা থেকে বাড়ী আসলেন।ইচ্ছামতো কেনাকটা করলেন এবার।সবার জন্য প্রয়োজনীয় ঈদ উপহার কিনে আনলেন।হবু বাচ্চার জন্যও কয়েক সেট জামা নিয়ে আসলেন।খুব বেশী দেরী নেই আর।ডেলিভারীর প্রত্যাশিত তারিখ(ইডিডি) ঈদের কয়েকদিন পরে।অনেক সময় প্রাকৃতিক কারনে সময় কিছুটা এগিয়েও আসে।সবধরনের প্রস্তুতিই নেওয়া আছে।

পরিবার কল্যান পরিদর্শিকার (এফডব্লিওভি)সাথে ফোনে কথা বলে বিস্তারিত জানান রহিম সাহেব।সবকিছু শুনে তিনি নরমাল ডেলিভারী হবে বলেই মতামত দেন।জটিলতা এড়াতে রহিম সাহেব তার পিতা সাদেক উদ্দিনের সাথে পরামর্শ করে উপজেলা সদরের প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের মালিক জলিল সাহেবের সাথে কথা বলে রাখেন।ফোন পাওয়া মাত্র অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে এমন ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে।সে বছর সবারই ধারণা ছিল রোযা ঊনত্রিশ দিনে যাবে।সে হিসাবে সবাই ঈদের প্রস্তুতিও নেন।সারা মাস রোযা রেখে ঈদের চাঁদ দেখা অনেক অানন্দের একটা বিষয়।রোযাদারদের জন্যতো বিশেষ আনন্দ।চাঁদ দেখার বিষয়টা ছোট বাচ্চাদের কাছে আরো বেশী খুশীর বিষয়।সবসময়ই মাগরিবের নামাযের আজানের একটু পরেই মসজিদের মাইকে চাঁদ দেখতে পাওযার ঘোষণা প্রচারিত হয়।টেলিভিশনেও চাঁদ দেখার ঘোষণা আসে।সাথে ঢাকা ও দেশের প্রধান প্রধান নগরীতে কখন কোথায় ঈদের নামাযের জামাত অনুষ্টিত হবে সে আগাম ঘোষণাও প্রচার হতে থাকে টেলিভিশনের বুলেটিনে।বারবার প্রচার হতে থাকে ঈদ আনন্দের চিরায়ত গান ” ও মন রমযানের ওই রোযার শেষে এলো খুশীর ঈদ…।”

ছেলে বুড়ো সকলে আনন্দে মেতে উঠে।

কোনো জায়গা থেকেই চাঁদ দেখতে পাওয়ার খবর আসছে না।একপর্যায়ে রেডিও টেলিভিশন কেন্দ্রগুলো ঘোষণা করতে লাগলো, দেশের কোথাও ঈদের চাঁদ দেখা যায় নি।লোকজন কিছুটা হতাশই  হল।রহিম সাহেব ঢাকায় তার সহকর্মীদের কাছে ফোন করেও জানতে পারলেন  তাদের এলাকাতেও চাঁদ দেখা যায় নি।সহকর্মীদের বাড়ী দেশের বিভিন্ন এলাকায়।রহিম সাহেবই শুধু নন সবাই নিশ্চিত হলেন যে কাল আর তাহলে ঈদ হচ্ছে না।শেষদিনের মতো সাহরী খাওয়ার উদ্দেশ্যে শেষরাতে উঠার জন্য যা যা প্রস্তুতি নেওয়া দরকার নিতে লাগলেন মহিলারা।রাত দশটা শম্পা যেন কেমন অস্বস্তী বোধ করতে লাগলো।একটু একটু ব্যাথা টের পাচ্ছে।জানতে পেরে রহিম সাহেব একই গ্রামের বাসিন্দা পরিবার কল্যান সহকারী রোখসানাকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন।রাতের বেলা।তাই রোখসানাকে আনার জন্য চাচাত ভাই হামিদ এবং রফিককে পাঠানো হলো।কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসিমুখে এসে উপস্থিত হলেন রোখসানা বেগম।সবকিছু দেখে শুনে বুঝে তারপর বললেন,কোনো চিন্তা করবেন না।তার ডেলিভারী বাড়ীতেই হবে।দীর্ঘদিন চাকুরীর সুবাদে এ লাইনে যথেষ্ট অভিজ্ঞ রোখসানা।তার উপর আস্থা রাখা যায়।গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকেও আজকাল নরমাল ডেলিভারী করানোর প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই আছে।বাড়ীতে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয় তাহলে শম্পাকে গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকে নিতে হবে। পাঁচ মিনিটের দূরত্ব।সেখানে নরমাল ডেলিভারীর যাবতীয় সু্বিধা রয়েছে।বর্তমান সরকার কর্তৃক কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।এর ফলে গ্রামের মানুষ  প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধাটা নিজ গ্রামেই পাচ্ছেন–যোগ করেন রোখসানা।সাদেক উদ্দিন,সখিনা বেগম রহিম সাহেব বাড়ীর মানুষ সবাই উৎকন্ঠিত।কি হয় জানি আল্লাহই জানেন।সাদেক উদ্দিন সাহেব ওযু করে ওজিফার কিতাব হাতে নিয়ে অনুচ্চস্বরে সুরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন।সখিনা বেগমের হাতেও তবজীঃ লা ইলাহা ইল্লা আন্তা..যোয়ালেমীন।

একটু পরেই রোখসানা বেগম অপেক্ষমান সবাইকে খুশীর সংবাদটা দিলেন।নাতি জন্ম নিয়েছে সাদেক উদ্দিন সাহেবের।রহিম সাহেবের দুচোখ জুড়ে আনন্দাশ্রু।সবাই যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লো।ছেলেকে দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠলেন রহিম সাহেব। তাকে ভিতরে নেওয়া হলো।ওমা শম্পার কোলজোড়ে এ যেন পূর্নিমা চাঁদ।হাত বাড়িয়ে চাঁদটাকে ধরতে ধরতে ভাবলেন  একে পেয়ে ঈদের চাঁদ দেখতে না পারার বেদনাটা ভুলে গেলাম! আলহামদুলিল্লাহ।আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করলেন রহিম সাহেব।

ঠিক এসময় (রাত ১১-৩০মিঃ)গ্রামের মসজিদের মাইক থেকে ঈমাম সাহেব ঘোষণা করলেনঃ

-ঈদের চাঁদ দেখা গেছে।কাল ঈদ।সবাইকে ঈদ মোবারক।

আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার……… ওয়ালিল্লাহিল হামদ।

Continue Reading

For Any Inquiry

dailybanglamirror@gmail.com

স্বত্ব © ২০২২ - ২০২৫ বাংলা মিরর | সম্পাদক : মোঃ খায়রুল ইসলাম সাব্বির