বাংলাদেশের রাজনীতি ও শিক্ষা খাতের নৈতিকতার অবনতি একটি উদ্বেগজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক দশকে, নৈতিকতার প্রতি উদাসীনতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষাকে একটি জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবে গণ্য না করে, একে অনেকাংশেই রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে।
রাজনীতি ও শিক্ষার মধ্যে গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবে এই সম্পর্কটি এখন একটি নেতিবাচক মোড় নিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দলীয়করণ, এবং ক্ষমতার অপব্যবহার শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব প্রায়শই নীতিমালা ও মানদণ্ডের বাইরে গিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ ধরনের অনিয়ম শুধু শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে না, বরং তাদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠা করে—যে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চেয়ে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থ অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান বাস্তবতা আরও গুরুতর হয়ে উঠছে, যখন আমরা দেখতে পাই যে নৈতিক শিক্ষার অভাবে সমাজে বিভাজন, সহিংসতা এবং অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনা শিক্ষার পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে। এই অবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, অনাস্থা এবং নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেয়, যা তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে, আশার আলো এখনো নিভে যায়নি। পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি সচেতন সমাজ এবং সুশাসন। রাজনীতিবিদদের উচিত হবে শিক্ষা খাতকে তাদের স্বার্থের বাইরে রেখে, এটিকে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নৈতিকতাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞান অর্জন, নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা, এবং মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন। এজন্য, শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিকতার চর্চা বাড়ানোর জন্য নীতিনিষ্ঠ ও আদর্শিক শিক্ষকদের নিয়োগ, শিক্ষা নীতির সঠিক বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর জন্য কেবল পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ না থেকে, সহশিক্ষা কার্যক্রম ও সামাজিক কার্যকলাপের মাধ্যমেও তাদের নেতৃত্ব গুণাবলি এবং নৈতিক দায়িত্বশীলতা তৈরি করা জরুরি।
একটি সুষ্ঠু, নৈতিকতাপূর্ণ ও রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা কেবল একটি শিক্ষিত জাতিই পাব না, বরং ভবিষ্যতে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও মানবিক বাংলাদেশও গড়ে তুলতে পারব। সেই বাংলাদেশ হবে এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে শিক্ষা ও নৈতিকতা রাজনীতির ওপরে স্থান পাবে এবং সত্যিকার অর্থে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে।