২০২৪ সালের ৫ আগস্ট—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ, যুবসমাজের ক্ষোভ আর সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের জমে থাকা হতাশা একসঙ্গে মিলিত হয়ে যেদিন রাজপথে গর্জে ওঠে, সেদিনই টলাতে থাকে দীর্ঘকাল ধরে শাসন করা আওয়ামী লীগ সরকারের ভিত্তি। শেষপর্যন্ত আন্দোলনের চাপে পতন ঘটে সরকারের, এবং গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন মানবিক সরকার—যা আপাতত দেশের প্রশাসনিক ভার বহন করছে।
এই ঘটনার পর থেকেই যেন বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রবাহে এক আশ্চর্য পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। একে একে আত্মপ্রকাশ করেছে ২৬টিরও বেশি নতুন রাজনৈতিক দল ও প্ল্যাটফর্ম—যার বেশিরভাগই পূর্বে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ব্যক্তি কিংবা বিভিন্ন দল থেকে বহিষ্কৃত, প্রত্যাখ্যাত, এমনকি দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়েই গঠিত। আশ্চর্যের বিষয়, একসময়ের অপরাধপ্রবণ কিংবা অকার্যকর পরিচিত রাজনৈতিক মুখরাই আজ নতুন মোড়কে ‘জনসেবা’র প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ফলে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে—এদের হাতে কি আদৌ দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ?
এর চেয়েও বেশি হাস্যকর যে, বিনোদন অঙ্গনের এক ব্যর্থ নায়ক, যিনি নিজের শিল্পী সমিতিতে কার্যকর কোনো প্রশাসনিক দক্ষতা দেখাতে পারেননি, তিনিও আজ ‘দেশ চালানোর’ স্বপ্নে বিভোর হয়ে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। যেখানে শিল্পীদের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে পথ চলবেন—তা ভেবে মানুষ শুধু বিস্মিতই নয়, হতাশও।
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তুলনামূলক সহনশীল আচরণ ও মানবিক অবস্থান দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক অদ্ভুত বিশৃঙ্খল স্বচ্ছন্দতা সৃষ্টি করেছে। ফলে, অনেকেই ‘যার যা খুশি, সে তাই করছে’ অবস্থা উপভোগ করছেন। কেউ নতুন দল গড়ছেন, কেউ পুরাতন দল ভেঙে জোট করছেন, কেউ আবার দীর্ঘদিনের অপ্রাসঙ্গিক দাবিকে হঠাৎ সামনে টেনে এনে নতুন রাজনৈতিক এজেন্ডা তৈরি করছেন। ১৭ বছর ধরে যেসব দাবি ও দাবিদার লুপ্তপ্রায় ছিল, তারা হঠাৎ যেন জেগে উঠেছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ওপর একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ বরাবরের মতোই বর্তমান আছে, বরং আগের চেয়ে তা আরও তীব্র হয়েছে। পশ্চিমা শক্তিগুলো এখন নজর রাখছে শুধু নির্বাচনের দিকে নয়, বরং নির্বাচনপূর্ব ‘প্ল্যাটফর্ম বিল্ডিং’ এবং ‘ইনস্টিটিউশনাল রিফর্ম’ বা কাঠামোগত সংস্কারের দিকেও। ফলে একধরনের বহুমুখী চাপ স্পষ্ট—যার মাঝে সরকার, রাজনৈতিক দল, এবং সাধারণ মানুষ তিন পক্ষই এক ধরনের অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত।
এই রাজনৈতিক নৈরাজ্যের মাঝখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের পথে কোনটি হবে প্রধান? বড় দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান এখন স্পষ্ট। একদিকে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে, যাতে তারা পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে; অন্যদিকে, নতুন দল ‘নাগরিক পার্টি’ রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার ও ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ‘গণহত্যার’ বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন মেনে নিচ্ছে না।
এই বিপরীতমুখী অবস্থান দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে এক জটিল ও অনিশ্চিত মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামনে হয়তো বাংলাদেশ এক নতুন বিপ্লবের পথে এগোচ্ছে—অথবা হয়তো আমরা আবারও প্রবেশ করতে যাচ্ছি অন্ধকারের এক চক্রে। কেউ বলছেন, এই রাজনৈতিক প্রলাপে যদি দ্রুত সমাধানের পথ না খোঁজা হয়, তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
মানুষ আজ দ্বিধান্বিত, উদ্বিগ্ন। একদিকে তারা নতুন সূচনার সম্ভাবনায় আশাবাদী, অন্যদিকে পুরোনো অস্থিরতার আশঙ্কায় আতঙ্কিত। এখন প্রশ্ন একটাই—কোন পথে বাংলাদেশ? আমরা কি সত্যিই একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছি, নাকি পুরোনো ভ্রান্তির পুনরাবৃত্তিই হবে আমাদের ভবিতব্য?
এই সন্ধিক্ষণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত হবে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, ক্ষমতার খেলার বদলে সংলাপ ও সমঝোতার পথ খোঁজা। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বর্তমান সিদ্ধান্তগুলোর ওপর। তাই, এখন সময়—ভবিষ্যতের জন্য দায়িত্ববান হওয়ার।